নার্সারি ব্যবসার আদ্যোপান্ত, ঝুঁকি কম লাভ বেশি
নার্সারি ব্যবসা কী:
একটি স্থানে যখন পরিকল্পিত পরিচর্যায় চারাগাছ উৎপাদন ও বেরে উঠে তাকেই মূলত নার্সারি বলা হয়। বর্তমানে কৃষির আধুনিকায়ন ও বাণিজ্যিকভাবে কৃষি বাগান বৃদ্ধির ফলে দিন দিন নার্সারির চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবিলায় আধুনিক কৃষিতে জোর দিচ্ছে প্রতিটি দেশ। এমন বাস্তবতায় নার্সারি ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক। এখানে তুলনামূলক প্রাথমিক বিনিয়োগ কম থাকায়, ঝুঁকিও কম।
পূর্ব পরিকল্পনা:
নার্সারি ব্যবসায় নামতে হলে আপনাকে অবশ্যই একটি পূর্ব পরিকল্পনা সাজাতে হবে। এছাড়া পরিকল্পনার একটি খসড়া করতে হবে। যেখানে বাজেট অনুযায়ী ব্যবসা শুরু থেকে প্রথম ছয় মাস কীভাবে চলবে তার একটি গ্রাফ তৈরি করতে হবে। কোনোরকম নার্সারি করলে করাই যায়; তবে এখান থেকে সফল ও ভালো মুনাফা করতে চাইলে আপনাকে পূর্ব পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।
এলাকা ও স্থান নির্বাচন:
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে এলাকা নির্বাচন করতে হবে। এলাকা বাছাইয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে; আশপাশে কৃষি প্রজেক্ট, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। এছাড়া স্থান নির্বাচনে এমন জমি বেছে নিতে হবে, যেখানে একসঙ্গে অন্তত ৩০ থেকে ৫০ শতক জমি থাকবে। যে জমিটি খালি পড়ে আছে এবং আগামী ৫-১০ বছর জমিটি মালিকের অন্য কাজে প্রয়োজন হবে না। এছাড়া তুলনামূলক কম খরচে পাওয়া যাবে।
জমি ভাড়া না নিয়ে লিজ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তাহলে খরচ কমে যাবে। কারণ এতো বড় জমি ভাড়া নিলে খরচ বেড়ে যাবে। এতে শুরুতেই হোচট খাবেন। চেষ্টা করবেন অন্তত ৩-৫ বছরের লিজ চুক্তি করতে। ৩০ শতক জমি বাৎসরিক লিজ ১৫-২০ হাজার টাকার মধ্যে হলে ভালো হবে। তবে এলাকা বেদে এটা আরো কম বেশি হতে পারে।
পুজি সংগ্রহ:
ব্যবসায় মূলধন অন্যতম কারিগর। কারণ বিনিয়োগ যত বেশি হবে, মুনাফা তত বেশি হবে এটা ব্যবসার প্রাথমিক সূত্র। পরিকল্পনা মতো জমি পেয়ে গেলে এবার টাকা যোগাড় করুন। অর্থ যোগাড় হলে ব্যবসায় নেমে পড়ুন।
অবকাঠামো নির্মাণ:
নার্সারিতে অবকাঠামো বলতে চারদিকে নিরাপত্তা কাঠামো ও বীজতলার সেড নির্মাণ আবশ্যিক। এছাড়া ড্রেনেজ ও পানির লাইন করতে হয়। বাশ ও কাঠ দিয়ে দুটো ছোট ঘর নির্মাণ করতে হবে। যেখানে, অস্থায়ী অফিস, ল্যাব ও রাতে একজনের থাকার ব্যবস্থা হবে। চারা গাছ পরিচর্যায় কিছু যন্ত্রপাতি কিনতে হবে।
ধাপে ধাপে ব্যবসা কার্যক্রম শুরু:
অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হলে মূল কার্যক্রম শুরু করুন। এ পর্যায়ে উৎপাদনে চলে যান। নিজের সৃজনশীলতা ও মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটান। কয়েকটি ধাপে উৎপাদনে যাবেন।
১। বীজ থেকে চারা উৎপাদন
নার্সারিতে বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে বিক্রি খুব লাভজনক। তবে এ প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শ্রমিক নিয়োগ দিতে হবে, অথবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এছাড়া বাশের ফ্রেম দিয়ে ভালো একটি স্থায়ী পলিসেড নির্মাণ করতে হবে। যেটি হবে বীজতলা। এখানে বীজ থেকে চারা উৎপাদন করতে হবে। স্থায়ী পলিসেড থাকলে অধিক বৃষ্টি বা প্রখর রোদে চারা উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না।
২। কলম থেকে চারা উৎপাদন
কলম থেকে চারা উৎপাদন আরেকটি সেরা পদ্ধতি। এতে কম সময়ে অধিক চারা উৎপাদন করা যায়। এছাড়া কলমের চারায় ফলন ভালো হয়। নার্সারিতে এ পদ্ধতিতে বেশিরভাগ চারা উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
প্রাথমিকভাবে কোনো ভালো ফলনের গাছে কলম দিয়ে চারা করবেন। প্রাথমিকভাবে আপনার কাছে কলম দেওয়ার মতো গাছ না থাকলে, গাছ সংগ্রহ করুন। নয়তো কারো গাছে চুক্তি করে কলম দিয়ে চারা আনুন। এছাড়া কিছু কিছু গাছের ডাল কেটে এনে চারা দেওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে আসুন। যেমন; ড্রাগন ফল গাছ, গোলাপ ফুল গাছ। তবে কলম চারার জন্য পলি সেড প্রয়োজন নেই।
৩। পাইকারি চারা
আপনি নতুন শুরু করার পর আপনার বীজতলা ও কলম থেকে চারা উৎপাদন হতে এক থেকে দুমাস পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। তাই এই সময়ের মধ্যে পাইকারি চারা কিনে এনে ব্যবসা শুরু করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বড় কোনো নার্সারির সঙ্গে চুক্তি করতে পারেন। কয়েক মাসের মধ্যে আপনি যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবেন তখন আর পাইকারিতে আর চারা আনতে হবে না।
যেসব চারা বেশি উৎপাদন করতে হবে:
১। সৃজনাল চারা
সৃজনাল চারা বলতে শীত মৌসুমের আগে শীতকালে যেসব সবজি গাছ হয় সেগুলো উৎপাদন ও গ্রীষ্ম কালেও একই পদ্ধতি। তাহলে প্রতি সৃজনে আপনি ভালো একটি মুনাফা পাবেন। স্থানীয় কৃষকদের চাহিদা জরিপ করে সবজির চারা উৎপাদন করতে পারেন। যেমন; ফুল কপি, বাধা কপি
২। ফুল গাছ
নার্সারিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছের চারা উৎপাদন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কিছু চারা বীজ থেকে এবং কিছু কলম থেকে উৎপাদন করবেন। বর্তমান সময়ে মানুষের রুচিবোধ পরিবর্তন ও শৌখিনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন ফুল গাছের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফুলের চারা বিক্রি করে ৬০-৭০ পর্যন্ত মুনাফা হতে পারে।
৩। ফল গাছ
ফল গাছের চারার মধ্যে রয়েছে; পেয়ারা, জামরুল, পেপে, আম, লিচু, নারিকেল। এছাড়া বিদেশি ফলের গাছ; মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর, স্ট্রবেরি, খেজুর, ড্রাগন ও তীন ফল। এসব চারা গাছের চাহিদা বর্তমানে অনেক বেশি। এগুলোর মধ্যে আম ও লিচু ভালো কলম দিতে পারলে অনেক মুনাফা সম্ভব। এ জন্য আপনাকে এসব চারা নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষিত প্রজন্ম, ফলের বাগান করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। তাই ফল গাছের ভালো চারা বের করতে পারলে নার্সারির মূল মুনাফা এখান থেকেই বের করা সম্ভব।
৪। সবজি চারা
সবজি চারা মৌসুম বেদে করতে হয়। তবে উন্নতমানের বীজ থেকে অফ সৃজনে সবজির চারা বের করতে পারলে। ভালো বিক্রি হবে। সবজি চারার মধ্যে রয়েছে; মরিচ, টমেটো, বেগুন, ক্যাপসিকাম, কপি, লাউ, ব্রুকলি, লেটুস।
৫। মানি প্লেন্ট
আপনার নার্সারি যদি একটু শহরাঞ্চলে হয় তাহলে আপনি মানপ্লান্টসহ এ প্রজাতির চারা উৎপাদন করতে পারেন। শহরের সৌখিন মানুষের নাসার বেলকনিতে এটি খুজে না পাওয়াটা অস্বাভাবিক। এ চারা উৎপাদন বেশি কষ্ট করতে হয় না। কম রোদ ও কম যত্নেও এ চারা বেচে থাকে, এছাড়া সামান্য ডাল থেকেও নতুন চারা উৎপাদন হয়। প্রতিটি পলির চারা অন্তত ১০০-১৫০টা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। তবে আপনার নার্সারি গ্রামাঞ্চলের দিকে হলে এটি কম উৎপাদন করাই শ্রেয়।
চারা বিক্রিতে বাজার তৈরি:
আপনি যদি পরিকল্পনা করে এগোতে পারেন তবে এ ব্যবসায় সফল হতে আপনাকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। চারা বিক্রি করতে আপনি যদি একটি বাজার তৈরি করতে পারেন, তাহলে আপনার সফলতার রাস্তা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে আপনি দুটো পথ বেছে নিতে পারেন।
- অনলাইন।
- অফলাইন।
১। অনলাইনে আপনার নার্সারির নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করবেন। পরে একটি ফেসবুক পেজ খুলে সেখানে প্রচারণা চালাবেন। এতে আপনার বিক্রির পরিধি ব্যপক হবে। অনলাইনে ভালো ক্রেতার সাড়া পাবেন। তবে এ ক্ষেত্রে আপনাকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে পণ্য ডেলিভারি দিতে হবে। কোনোভাবেই নেগেটিভ ইম্প্রেশন তৈরি করা যাবে না। প্রয়োজনে কিছু ক্ষত্রে লস কিংবা ছাড় দিয়ে হলেও ইতিবাচক ইমেজ ধরে রাখতে হবে।
২। এছাড়া অফলাইনে বিক্রির কিছু ক্ষেত্র রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে;
- অনফিল্ড বিক্রি
- পাইকারি বিক্রি
আপনি ভালো সেবা দিলে আপনার আশপাশের এলাকা থেকে অনেক ক্রেতা পাবেন। যারা আপনার নার্সারিতে এসে চারা কিনে নিয়ে যাবেন, এছাড়া ভালো সার্ভিস পেলে তারা বারবার কিনতে আসবেন।
অপরদিকে আপনি বিভিন্ন ছোট নার্সারিগুলোর কাছে চারা পাইকারি বিক্রি করতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গেও চুক্তি করতে পারেন।
বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে চুক্তি
বর্তমানে অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের অফিস ও কারখানাগুলোকে গ্রীন অফিস বা গ্রীন কারখানা করার পথে হাটছেন। এতে এ খাতে আপনি একটি সুযোগ তৈরি করতে পারেন।
জৈব সার ও বীজ বিক্রি
নার্সারিতে জৈব সার ও বীজ বিক্রি করে অতিরিক্ত আয় করতে পারেন। এটি অত্যন্ত সহজ এবং ক্রেতা হাতের মুঠোয়। যারা আপনার থেকে চারা নেবেন, তারা অবশ্যই আপনার কাছে সার-বীজ থাকলে তাও নেবেন। তাই এগুলো যুক্ত করে আয় বাড়াতে পারেন। জৈব সার ও বীজ পাইকারি বীজের বাজার থেকে সংগ্রহ করবেন।
গাছের মাটি বিক্রি
সার-বীজের মতো গাছের মাটি বিক্রিও একটি সহজ পদ্ধতি। তবে এ ক্ষেত্রে মাটি সংগ্রহ একটি কঠিন কাজ। তবে আপনার আশপাশে খালি জমি থাকলে আপনি সহজেই মাটি কিনে আনতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে আপনাকে বেলে ও দোয়াশ মাটি সংগ্রহ করতে হবে। এ দুই প্রকারের মাটি অধিকাংশ গাছের জন্য আদর্শ। মাটির সঙ্গে গোবর সার ব্যবহার করবেন।
নার্সারি ব্যবসা করতে হলে মাটি আপনার কাছে রাখতেই হবে। নিজের এবং ক্রেতার প্রয়োজনে নার্সারিতে মাটি আবশ্যিক। প্রতিবস্তা সারযুক্ত মাটি অন্তত ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবেন।
গাছের পরিচর্জা সামগ্রী ও ট্রি পট বিক্রি
নার্সারিতে গাছের পরিচর্যা সামগ্রী ও ট্রি পট বিক্রি করে ভালো আয় করতে পারেন। এগুলোর ক্রেতাও আপনার চারা ক্রেতারাই। এছাড়া অনলাইনে একটি বড় বাজার পেতে পারেন।
বনশাই গাছ তৈরি ও বেচাকেনা:
বিশ্বের অনেক দেশে শুধুমাত্র বনশাই একটি বৃহৎ পরিসরের ব্যবসা। বনশাই করা গাছ দেশ-বিদেশে বিক্রি করা যায়। একেকটি গাছ লাখ টাকা থেকে শুরু হয়ে অর্ধ কোটিতেও বিক্রির রেকর্ড রয়েছে।
তবে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ সময়ের বিষয়। একেকটি গাছ ১-২ ফুট উচ্চতার হলেও একেকটি গাছের বয়স অন্তত ৫-১০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়া এ কাজে আগে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। নয়তো বনশাই এ সফল হওয়া যাবে না।
তবে বনশাই নিয়ে ধর্মীয়ভবে অনেক ব্যখ্যা রয়েছে। ইসলাম ধর্মে বনশাই করতে মানা করা হয়েছে। কারণ; যেহেতু গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত করা হয়। তাই নার্সারিতে বনশাই করা একান্তই আপনার বিবেচ্য বিষয়।
গাছ পরিচর্যা সার্ভিস:
গাছের পরিচর্যা একটি নতুন ও ক্রিয়েটিভ আইডিয়া। আপনি নার্সারি ব্যবসার পাশাপাশি গাছের ডাক্তার হিসেবে সেবা দিতে পারেন। গাছ পরিচর্যা সার্ভিস আপনার আশপাশের এলাকায় দিতে পারেন।
কাস্টমারের বাসায় গিয়ে গাছের পরিচর্যা সার্ভিস দিতে পারেন। এ জন্য আপনাকে একটি দক্ষ টিম গঠন করতে হবে। প্রয়োজনে টিমকে ট্রেনিং এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করতে হবে। তবে এ সার্ভিস শুধুমাত্র শহরাঞ্চলে যুক্তিসঙ্গত হবে।
লেখকের মতামত;
যেকোনো ব্যবসাতেই মুদ্রার দুই পিঠের মতো, লাভ কিংবা ক্ষতি দু'টোই আছে। তবে প্রতিটি ব্যবসায় নামার আগেই অন্তত সে বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান নিয়ে শুরু করা উচিৎ। এছাড়া ব্যবসায় সফল হওয়ার অন্যতম মূলমন্ত্র; ধৈর্য, পরিশ্রম ও চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। এছাড়া সৎভাবে ব্যবসার মানসিকতা দীর্ঘ সময় টিকে থাকার বড় পুজি। নার্সারি ব্যবসাটি এক প্রকার প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব। প্রকৃতি প্রেমীরা এ ব্যবসায় ভালো সাফল্য পেতে পারেন।






মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন